লেনিন সমাধির ভবিষ্যত  

রাশিয়া এখন:
লেনিন সমাধির ভবিষ্যত


আমার স্মৃতি সেই সোভিয়েত দেশের যার সঙ্গে লেনিন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত৷ লেনিন ছাড়া সোভিয়েত দেশ বা সোভিয়েত দেশ ছাড়া লেনিন কোনদিন কি ভাবা গেছে না যায় ? সোভিয়েত দেশে লেনিন কোথায় ছিলেননা ? সর্বত্র৷ রাস্তা, বাড়ী, লাইব্রেরী, মেট্রো, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলখজ(collective firm), সাবখজ(State firm) সব লেনিনের নামে৷ লেনিন কমসোমল, লেনিন জাহাজ, লেনিন বন্দর, লেনিন শহর৷ প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর, গ্রামে সব থেকে বড় রাস্তা, চক, কেন্দ্র, বিল্ডিং সব, সব, সব ছিল লেনিনের নামে৷ তার মূর্তি ছাড়া ভাবা যেতনা কোন শহর৷ তার বই পত্র লক্ষ লক্ষ কপিতে ছাপা হত, বই এর দোকান আর লাইব্রেরীর সব থেকে দৃষ্টিগোচর স্থানে থাকত তার রচনাবলী৷ কোন বক্তৃতা, কোন অনুষ্ঠান শুরু বা শেষ হতনা তার নাম উল্লেখ বিনা৷ লেনিনের ছিল এমনই এক সর্বব্যাপি উপস্থিতি৷

২০০৭ সাল৷ সর্বত্র খুজেছি তাকে৷ নেই তার নাম কোথাও৷ লেনিনের নাম তুলে দেবার জন্য ব্যাপক এবং সংগঠিত এক সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টা নজরে পড়লো সব শহরেই৷ কিন্তু তার উপস্থিতি মুছে ফেলা কি সোজা? সেই প্রমান সর্বত্র৷ বড় বড় শহরের বাইরে যে বিশাল রাশিয়া, সেখানে আজও লেনিন স্বমহিমায় বিরাজমান৷

দুদশক আগে মস্কোয় কয়েক বার লেনিন সমাধি দেখতে গেছি৷ প্রতিবারই অনেক বড় লাইনে দাড়াতে হয়েছে৷ এবার তিন তিন বার চেষ্টা করলাম৷ প্রতিবারই কোন না কোন বাহানায় বন্ধ থাকল৷ রেডিও, টেলিভিশন এবং পত্র পত্রিকায় প্রায়ই শোনা যাচ্ছে নানান গুজব৷ লেনিনের দেহ এখানে থাকবে কি থাকবেনা৷ সাধারণ রীতি অনুযায়ী তাকে কবর দেয়া হবে কি হবেনা তাই নিয়ে নানান অভিমত৷

১৯২৪ সনের ২১শে জানয়ারী লেনিনের মৃত্যু হয়৷ সারা রাশিয়া থেকে প্রায় ১০০০০ টেলিগ্রাম আসে সোভিয়েত সরকারের কাছে, একটাই প্রত্যাশা, সরকার যেন পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের জন্য লেনিনের দেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন৷

২৩শে জানুয়ারীর সকালে বিখ্যাত রুশ বিজ্ঞানী আলেক্সেই আব্রিকসভ লেনিনের দেহকে emblame করেন যাতে লেনিনের শরীর কবর দেয়া অবধি অক্ষত থাকে৷২৩শে জানুয়ারী রাতে architect আলেক্সেই শুশেভকে দায়িত্ব দেয়া হয় তিন দিনের মধ্যে একটি সমাধিস্থলের পরিকল্পনা এবং রুপায়ণ করতে যাতে হাজার হাজার শোকাকুল মানুষ লেনিনকে শেষ বিদায় জানাতে পারেন৷ ২৬শে জানুয়ারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে রেড স্কোয়ারে ক্রেমলীনের দেয়ালের কাছে তার সমাধি স্থাপিত করা হবে৷ ২৭শে জানুয়ারী শুশেভ কাঠের তৈরী সমাধিস্থল নির্মান করেন আর সেদিন বেলা ৪টার সময় লেনিনের কফিন সেখানে স্থাপন করা হয়৷ মাস দেড়েকের মধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ এখানে আসেন লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে৷ আগস্ট মাসে শুশেভ সমাধিস্থলের আকার বাড়িয়ে তাকে এক বড়সড় চেহারা দেন৷ সেই সময়কার সোভিয়েত সরকারের এতটা আর্থিক সঙ্গতি ছিলনা যাতে লাল গ্রানাইট পাথরে এটি তৈরী করা যায়৷ তা হয়েছে অনেক পরে৷ এর সামনের দিকের সেই বিখ্যাত প্লাটফর্মও ছিলনা তখন যার উপরে দাড়িয়ে সব সোভিয়েত নেতারা সেনাবাহিনীর প্যারেড দর্শন করতেন৷ কাঠের সমাধি বানাবার আরো একটা কারন হল-তখনকার প্রযুক্তির মান অনুযায়ী কত দিন লেনিনের দেহ রাখা যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ৷ ১৯২৯ সাল নাগাদ মনে করা হল যে লেনিনের দেহকে বেশি দিন রাখা যেতে পারে, অর্থাত্ সেই কলা কৌশল রুশ বৈজ্ঞানিকদের আয়ত্বে এসেছে৷ ঠিক করা হল যে কাঠের পরিবর্তে পাথর ব্যাবহার করা হবে৷ শুশেভ, ফ্রান্ট্সুজ আর ইয়াকভলেভ নামে তিন বাস্তুকারের নেতৃত্বে একটি দল marble, porphyry, granite, labradorite এবং অন্যান্য মাল মশলা ব্যাবহার করে তৈরী করলেন আজকের সমাধির৷ ১৯৩০ সালে পাথরের কাজ শেষ হয়৷ ইতিমধ্যে ১৯২৪ সালে মস্কোর সেনাবিভাগের জারী এক বিজ্ঞপ্তিতে সমাধিতে Guard of Honour এর ব্যাবস্থা করা হয়৷ রাশিয়ানরা একে এক নম্বর সেন্ট্রি বলে আখ্যা করে৷ সেনাবাহিনী থেকে বাছাই করা, সব থেকে পটু, কুশলী, লম্বা, কমবয়সী জোয়ানদের এখানে পাহাড়ায় লাগানো হত৷ ক্রেমলীনের ঘড়ির ঘন্টার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে দুজন সেনা হাতে বেয়নেট উচিয়ে মার্চ করে যেত লেনিন সমাধির দরজায়৷ ঠিক একই চেহারার আরো দুজন ইতিমধ্যে ওখানে দাড়িয়ে৷ এরা যেয়ে ঠিক তাদের সামনে দাড়াত৷ সবার চেহারার ভীষণ মিল৷ ঘড়ির শেষ ঘন্টার সঙ্গে চোখের নিমিষে তারা স্থান বদল করত৷ কখনই বোঝা যেতনা কারা এল বা কারাই গেল৷ এই দৃশ্য দেখবার জন্য প্রতি ঘন্টায় লেনিন সমাধির সামনে লাগত উত্সাহী জনতার ভীড় ( সোভিয়েত সরকারের পতনের পর ১৯৯৩ সালে রাশিয়ায় সাংবিধানিক সঙ্কটের সময় এ সেন্ট্রি প্রথা বন্ধ করা হয়)৷

এর পর এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল৷ নাজী বোমারু বিমান হানার হাত থেকে সমাধি স্থল কে বাঁচানোর জন্য এর চার পাশ ঘিরে একটা বাড়ীর মত করা হল৷ ১৯৪১ সালে অগ্রসরমান নাজী বাহিনীর হাতে মস্কো শহরের পতনের আশঙ্কায় লেনিনের দেহ সাইবেরিয়ার তুমেন শহরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়৷ যুদ্ধের পরে দেহ আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়৷ জার্মানির পতনের পর এর সামনে সেই বিখ্যাত প্লাটফর্ম তৈরী করা হয় যার কথা আগে বলেছি৷এ যাবত সমাধিস্থলটি লেনিনের নামেই থাকে৷ সামনের দিকে বড় বড় অক্ষরে রুশ ভাষায় লেখা থাকত- লেনিন৷ ১৯৫৩ সালে স্টালিনের মৃত্যু হয়৷ তখন তার দেহ লেনিনের পাশে স্থান পায় এবং সামনের দিকে বড় বড় অক্ষরে রুশ ভাষায় লেনিনের নামের নীচে লেখা হয়-স্টালিন৷ সঙ্গের দেয়া ছবিতে তখনকার সমাধি স্থল দেখা যাচ্ছে৷ তখন থেকে ৩১শে অক্টোবর ১৯৬১ অবধি স্টালিনের দেহ লেনিনের পাশেই থাকে৷ ক্রুশ্চেভ জমানায় স্টালিনের দেহ তুলে ক্রেমলিনের দেয়ালের কাছে কবর দেয়া হয়৷ শুরু থেকে আজ অবধি কয়েক কোটি মানুষ লেনিন সমাধি দর্শনে এসেছেন৷ প্রতি বছর একবার লেনিনের দেহকে নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মাখানো হয় যাতে তা নস্ট না হয় আর দেখতে আসলের মত থাকে৷ আমার দেখে মনে হয়েছে চামড়ার রঙ অস্বাভাবিক রকমের দেখতে -অনেকটা খেলনার মত৷

অনেকে আবার সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন এটা আদৌ লেনিনের দেহ কিনা৷ আগের সোভিয়েত বা বর্তমান রুশ সরকার এ বিষয়ে কখনই আলোকপাত করেননি যে লেনিনের শরীরের কতটা অংশ আসল বা নকল৷ তবে যে সমস্ত বিজ্ঞানী বা ইন্জিনীয়ররা লেনিনের শরীর সংরক্ষণের কাজে গত কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন বা করছেন তাদের পরিবারের লোকজন কিন্তু বলে থাকেন যে দেহ সত্যি আসল কিন্তু একে রক্ষণাবেক্ষণ করতে প্রতিদিন অনেক অনেক কিছু করতে হয়৷ যেমন দেহকে moisturize করা, ওষুধ ইনজেকশন দেয়া ইত্যাদি৷ তারা আরো বলেছেন যে নাকি নিয়মিত ভাবে বছরে একবার তাকে বের করে নিয়ে চান করানো হয়৷ এর কতটা সত্যি বা মিথ্যা তা আমি জানিনা৷
বরিস ইয়েল্তসিন উঠে পড়ে লাগেন লেনিনের দেহ এখান থেকে সরানোর জন্য৷ এ ব্যাপারে তাকে মদত্ দেয় রুশ অর্থোডক্স চার্চ৷ কিন্তু তার আমলে এ কাজ করতে তিনি সফল হননি৷ সোভিয়েত সরকারের পতনের পর প্রথম কয়েক বছরে খুব চেষ্টা হয় দেহকে সরাবার৷ কিন্তু আপামর জন সমাজের চাপে, রুশ কমুনিস্ট পার্টির দ্বারা চালিত অভিযানের ফল স্বরুপ কেউ এখনো অবধি এ কাজটি করে উঠতে পারেনি৷ আসলে রাশিয়ার বহু মানুষ যাদের জন্ম, শিক্ষা, চাকরী সব সোভিয়েত জমানায়, তারা যদিওবা কমুনিস্ট নন বা কমুনিস্টর পার্টিকে সমর্থন করেননা কিন্তু লেনিনকে এ রাষ্ট্রের জনক হিসাবে মানেন আর তারা চাননা লেনিনের দেহকে এখান থেকে সরানো হোক৷ যারা দেহ সরাবার পক্ষে তাদের অনেকে এমন বলে থাকেন যে লেনিন তার বোনের কাছে এক চিঠিতে লিখে গেছেন যে তার মৃত্যুর পর তার দেহ যেন কবর দেয়া হয়৷ আর এ বিষয়েরই উল্লেখ করে তারা বলেন যে তার দেহ মস্কোর সমাধি থেকে লেনিনগ্রাডে তার আত্মীয় স্বজনের সাথে এক স্থানে কবর দেয়া হোক৷ এ সমস্ত লোকেদের চেষ্টা এখনো অবধি হৈ চৈর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে৷ তারা কেউ কেউ এমনো বলেছেন যে আর বছর কুড়ি অপেক্ষা করলে সোভিয়েত জমানার মানুষের সংখ্যা এত কমে আসবে যে প্রতিরোধের জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না৷ তখন নির্বিবাদে লেনিনের দেহ সরিয়ে ফেল্লে হল৷ কিন্তু তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ রুশ কমুনিষ্ট পার্টির সমর্থকরা প্রতিবছর নিয়মিত ভাবে এখানে মে দিবস, বিজয় দিবস (৯ই মে), বিপ্লব দিবস(৭ই নভেম্বর) ইত্যাদি পালন করে এই অঙ্গীকার নেন যে এখান থেকে লেনিনের দেহকে কিছুতেই সরাতে দেয়া হবেনা৷
সমাধিস্থল সোম থেকে শুক্রবার প্রতিদিন সকাল ১০০০ থেকে বেলা ১৩০০ অবধি খোলা থাকে৷ আজও সেখানে সব সময় লম্বা লাইন দেখা যায়৷ কোন ফটো বা ভিডিও তোলা নিষেধ৷ এই লেখার সাথে লেনিনের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া৷লেনিনের দেহ সংরক্ষণ এবং জনসমক্ষে প্রদর্শনের ব্যাবস্থায় অনুপ্রেরিত হয়ে মাও সে তুং, হো চি মিন আর কিম ইল সুং এরও সমাধি তৈরী হয়েছে৷
লেনিনের দেহ নিয়ে বাদ বিদাদ চলছে৷ রেড স্কোয়ারে সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতীক থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করবে আগামী দিনে রুশ কমুনিষ্ট পার্টি ও লেনিন অনুগামীদের জনসমর্থন ও ক্ষমতার উপরে৷ আর তা বুঝতে হলে জানতে হবে আজকের রাশিয়ায় রুশ কমুনিষ্ট পার্টির স্থান ও ক্ষমতা কতটুকু৷ সে বিষয়ে বিস্তারিত পরের বার৷



এই লেখাটি এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে আমার ব্লগেও পড়তে পারবেন http://indmusings.blogspot.com/ আপনার মতামতও সেখানে জানাতে পারেন৷

AddThis Social Bookmark Button

0 comments

Post a Comment

Energy News from the World

Energy News from the World
Editors Pick