This is a travelogue on Russia. It is written in Bengali.
Photo credit atbaker
রাশিয়া এখন
২০০৭ এর সেপ্টেন্বরে দুমাসের জন্য হঠাত্ এক সুযোগ এসে গেল রাশিয়া যাবার ৷
১৯৮৪ সালের ১৩ই মে ছিল এক রবিবার৷ আমি ১২ বছর একনাগাড়ে থাকার পর সেই সন্ধায় মস্কোর শেরেমিতিয়েভা এয়ারপোর্ট থেকে দেশের প্লেনে চড়ি৷
সেদিনের পর অনেক দিন কেটেছে, খুব প্রচলিত এক কথায় বলতে গেলে গঙ্গা ও ভল্গা দিয়ে বয়েছে অনেক অনেক জল৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের দেশ আর নেই, নেই পৃথিবীর বৃহত্তম সমাজতান্ত্রিক দেশ৷ ১৯৮৪র সেই দিনে এসবের কিছু টের পাইনি আমরা ঘুনাক্ষরেও৷ তাই ভারতে ফিরবার আগের রাতে আমার পিএইচডির গাইড, অধ্যাপক ভিক্তর, লেনিনস্কি প্রসপেক্ট(রাস্তা)র তার ২ রুমের ফ্লাটে রাতে খাবার আমন্ত্রণ জানান৷ অনেক অনেক কথা হয় সেদিন৷ কি কারণে জানিনা এক প্রশ্নের উত্তরে আমি নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলাম যে এইতো দেশে যাচ্ছি, বছর ছয়েক পরে একটু থিতু বিতু হলেই ১৯৯০এ বেড়াতে আসছি মস্কোয় আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে৷
আমি জানিনা কেন সেদিল ১৯৯০ সালের কথা বলেছিলাম, হয়তো বা মনের কোনে এমন একটা ভাবনা ছিল যে ভারত ফিরে থিতু হতে, চাকরী , পরিবার এসবের জন্য বছর ৬ নিশ্চয় লাগবে, তার পর আমার সুযোগ আসবে আবার আসবার৷ আমার মনে পড়ে সেই ১৯৮৪ সালে মস্কো ছাড়বার আগেই নস্টালজিক ছিলাম৷ ১৯৮৪ সালের মস্কো ছিল সত্যি সুন্দর এক শহর৷ অনেক অনেক খোলা মেলা জায়গা নিয়ে এ শহর৷ ক্ষমতায় শক্তিশালী এক কমুনিস্ট পার্টি যা সফল ভাবে দেশ চালনা করছিল৷ তখন আমার আসার ঠিক আগের ৩ বছরে নেতৃত্বের বদল ঘটে৷ ব্রেঝনেভ মারা যান ১৯৮২তে, তারপর আন্দ্রোপভের মৃত্যু হয় ১৯৮৩তে, চেরনেন্কো ক্ষমতায় আসেন৷ তার মৃত্যু হয় ১৯৮৫ সালে৷ তারপর ক্ষমতায় আসেন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা৷ মিখাইল গর্বাচোভ৷ যাই হোক যে কথা বলছিলাম, ১৯৮৪তে আমার আসবার সময় অসুস্থ চেরনেন্কো ক্ষমতায় আসেন৷ তিনি ছিলেন যথেষ্ট বয়স্ক কিন্তু সবাই এতে অভ্যস্তই ছিল৷ সব নেতারাই ছিলেন যথেষ্ট বয়স্ক৷ আমার ঠিক আসবার সময়ে আরো একটি ঘটনা ঘটে৷ সোভিয়েট ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়ার একটি যাত্রী বাহী বিমানকে গোয়েন্দা বিমান সন্দেহে গুলি করে নামায়৷ মৃত্যু হয় অনেক মানুযের৷ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রীগান সোভিয়েট ইউনিয়নকে শয়তানের সাম্রাজ্য আখ্যা দেয়৷ আমরা মস্কোয় জানতাম যে সত্যি ওটা স্পাই প্লেন ছিল কারণ সেই প্রথম সোভিয়েট টিভিতে পর পর বেশ কয়েক দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে ব্রিফিং দেয়া হত৷ এ সবের পটভুমিকায় আর একটি ঘটনা ঘটছিল- সোভিয়েত সৈন্যরা লড়ছিল আফগানিস্তানে৷ যে লড়াই শেষ হয় সোভিয়েত পতনের সঙ্গে সঙ্গে৷ তখন আমরা ছাত্ররা এসব নিয়ে একদম চিন্তিত ছিলাম না৷ আমাদের বয়স ছিল কম৷আমরা সোভিয়েত নেতৃত্বের ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলাম৷ মস্কোর জীবন স্বাভাবিক লয়ে চলছিল৷ আমি ১২ বছর পর ভারতে ফিরবার জন্য তৈরী হচ্ছি৷
বন্ধুরা কেউ রয়ে গেল, কেউ চলে এল আমার সাথে৷!
আমার প্রফেসরের সঙ্গে সেই সাক্ষাত হল, তবে তা বছর ৬ পরে নয়, ঠিক ২৩ বছর পরে৷
এবারে যাবার আগে থেকেই অনেক দুঃশ্চিন্তা ছিল! নানান্ কারণে! কি দেখব, কেমন সব কিছু পাব ইত্যাদি, ইত্যাদি! সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ রাত ৪৩০এ বিশালকায় এরোফ্লত বিমানের ভেতরে ঢুকে নজরে পড়ল একদল বিমান সেবকদের যারা অবাধ্য ভারতীয় যাত্রীদের সামাল দিতে ব্যস্ত৷ আজকাল এরোফ্লত বিমানে বিনামুল্যে মদিরা দেয়া বন্ধ, এই সমস্ত ভারতীয় যাত্রীরা আগে থেকেই পানাহার করে আসায় তাদের ভোলচালে খুব একটা কিছু করে দেখাবার ইচ্ছা প্রবল ছিল, আর তাদের সব এনার্জি তাই বিমান সেবকদের দৃষ্টি আকর্ষণেই চালিত ছিল৷ বলা বাহুল্য যে, কি জানি কোন কারণে এরোফ্লতের বিমানে, সেবিকাদের তুলনায়, সেবকরা ছিলো সংখ্যায় অনেক বেশী, আর তাদের মাঝারী বয়স ছিল ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে৷ এর আগে যখন রাশিয়ায় ছিলাম, এরোফ্লতের বিমানেই চড়েছি অনেকবার, আর এরোফ্লতের বিমান সম্বন্ধে ছিল বেশ উচু ধারণা৷ দেশে ফেরার পর পশ্চিমী গনতন্ত্রের প্রপাগান্ডা আমার মগজ ধোলাই করতে সক্ষম হওয়ায় আমার ধারণা অনেক পাল্টে যায় এরোফ্লতের বিমান সেবার মানের বিষয়ে৷ প্লেনের মধ্যে ঢুকে সব কিছু দেখে সেই ধারণারই পুষ্টি হল৷ লুফ্তহানসা, কেএলএম ইত্যাদিদের তুলনায় সুযোগ সুবিধা অনেক কম, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব, খাবার দাবার ভাল নয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ পাতলা কম্বল জড়িয়ে কষে এক ঘুম দিলাম৷ সেই ঘুম ভাঙ্গল মস্কো বিমান বন্দরে নামবার কিছুক্ষণ আগে৷ প্লেনের পেট থেকে বেড়িয়ে এ গলি সে গলি পেরিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে৷ সকাল ১০টা বাজে, এক সময়ে অনেকগুলে প্লেন এসে নেমেছে, তাই অনেক যাত্রীর ভীড়৷ আমার সাদা পাস্পোর্ট থাকায় একটু সুবিধা হল, সোজা গিয়ে দাড়ালাম ডিপ্লোম্যাটদের কাউন্টারে, সেখানে ভীড় কম অনেক ৷ হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি আমি স্ত্রীর সুবাদে ভারত সরকারের দেয়া সাদা রঙের পাস্পোর্ট নিয়ে যাচ্ছি রাশিয়ায়৷ মস্কোর শেরেমিতিয়েভা এয়ারপোর্ট এমন কিছু বদলায়নি৷ আজও মিলিটারী পোশাক পরা ব্যাক্তিরাই পাস্পোর্ট পরীক্ষা করলো আগের মত৷ কাউন্টার থেকে বেরুতে না বেরুতেই এক দঙ্গল ট্যাক্সীওয়ালা আমার পিছু নিল ঠিক দিল্লী কিংবা কলকাতা এয়ারপোর্টের মতই৷ হ্যাঁ, একথা বলে রাখি, এমন ঘটনা সমাজতন্ত্রের আমলে ঘটতনা৷ যদিও ছাত্রাবস্থায় বাসেই আমরা যাতায়াত করতাম বেশী, তবে ট্যাক্সীতে চড়িনি এমন নয়৷ ট্যাক্সীওয়ালারা তখন সরকারী কর্মী, তুমি তার গাড়ীতে চড় বা না চড়, তাতে তার বেশী কিছু আসত যেতনা৷ আমকে মস্কো পৌছে অন্য এক শহরে যেতে হবে প্লেনে, তাই অন্য এক এয়ারপোর্টে যেতে হবে যার নামও শেরেমিতিয়েভা, কিন্তু শেরেমিতিয়েভা-১৷ তার মানে দিল্লি থেকে মস্কোয় আমরা নেমেছি শেরেমিতিয়েভা-২ তে৷
ইন্টারনেটে আগেই জেনেছিলাম যে শেরেমিতিয়েভা-২ থেকে শেরেমিতিয়েভা-১ এ যাবার জন্য বিনামুল্যে বিশেষ বাসের ব্যাবস্থা আছে ৷ তাই আমি নাছোড়বান্দা ট্যাক্সীওয়ালাদের বিশেষ পাত্তা না দিয়ে গট্গট্ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম ফ্রি বাসে যাব বলে৷ বাইরে অনেক ভাল ভাল বাস, মিনিবাস দাড়িয়ে আছে৷ ২০ রুবল ভাড়া৷ বলে রাখা ভাল আমাদের আমলে বাসের ভাড়া ছিল ৫ কোপেক৷ ১০০ কোপেকে ১ রুবল৷ ঘন্টা ২ পরে আমাদের ফ্রি বাস এল, খুব ভীড়, বিদেশীরাই বেশী৷ আমরা পৌছে গেলাম ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট শেরেমিতিয়েভা-১ এ৷ পরবর্তী প্লেনের জন্য আমাকে ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে৷ ছোট এয়ারপোর্ট, বসার জায়গা কম৷ তারই মধ্যে কাটিয়ে দিলাম কয়েক ঘন্টা৷ খাবার দাবারের ভীষণ দাম৷ আমরা যখন রাশিয়ায় পড়তাম, সস্তার খাবারের দোকান ছিল অনেক৷ রুশ ভাষায় তাদের নাম ছিল স্তালোভায়া৷ সস্তার মানে, খারাপ মানের খাবার নয়৷ স্কুল, কলেজে, হাসপাতালে, পাড়ায় পাড়ায় ছিল অনেক অনেক স্তালোভায়া৷ সেখানে সস্তায় পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যেত৷ সাধারণ দুপুর বা রাতে আমরা খেতাম কম্পোত(শুকনো ফল সিদ্ধ করা জল), সুপ, আলুসিদ্ধ বা ভাত বা ম্যাকারনী দিয়ে মাংস, মাছ বা মুর্গী এবং কোন সুইট ডিশ৷ এই ছিল আম জনতার খাবার, এবং উচু, বড়, মাঝারি সব ধরণের জনতার পক্ষেই স্তালোভায়া ছিল সাধারণ খাবারের জায়গা৷ তবে হ্যাঁ, রেস্তোরাও ছিল, তা ছিল অপেক্ষাকৃত দামী৷
এখন এয়ারপোর্টে অনেকক্ষণ স্তালোভায়া খুঁজলাম, পেলাম না৷ তবে ম্যাকডোনাল্ড ছিল৷ ৩০০ মিলি মিনারেল জল ২৫০ রুবল(আজকাল ১ ডলার-২৫ রবল, ৪০ ভারতীয় টাকা)৷ খাবারের মেনুও গেছে বদলে৷ রাশিয়ায় পরবর্তী ২ মাস এই অবস্থাই দেখেছি৷ সে রাতে ২ ঘন্টার প্লেন যাত্রার পর পৌছে যাই আমার গন্তব্য শহর সিয়েভ্রদ্ভিন্সকে৷ মস্কো থেকে ১২০০ কিমি দুরে, শ্বেত সমুদ্রের পারে ছোট্ট শহর৷ এই শহর থেকেই যাই মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ(পুরানো নাম লেনিনগ্রাড)৷
অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়৷ চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াই আমার দেখা শহর আর দেশ৷ অনেক বদলে গেছে সব কিছু৷ সব লাল রং গেছে হারিয়ে৷ আলোয় আলোময় শহর৷ এখন নীল আর নীল৷ পুটিনের পার্টির পতাকার রঙ নীল আর প্রতীক ভালুক৷ সেন্ট পিটার্সবার্গ আমি বলতে পারিনা, বলতে গেলে লেনিনগ্রাডের নাম মনে আসে৷ পরে দেখলাম শুধু আমারই নয় , এখনো অনেক মানুষ এদেশে ঐ নামই বলেন৷ তাদের জন্ম সোভিয়েত ইউনিয়নে৷
মস্কোর রেড স্কোয়ার, লেনিন সমাধি, ক্রেমলীন, সব তেমনই আছে৷ আবার তেমনই বা কই ৷ সেখানে আলোর অভাব৷ রং নেই৷ বিশ্বায়নের দাপুটেরা, ম্যকডোনাল্ড, কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন সব জাঁকিয়ে বসে তাদের আড়াল করেছে৷
এবার প্রথম যেদিন রেড স্কোয়ার গেলাম- সে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা৷ ঠিক ঢোকার মুখে একি, খৃষ্স্টের মন্দির৷ পাশে ছিল লেনিন মিউজিয়ম, তার সব সাইনবোর্ড উধাও৷ তবে কি লেনিনের সমাধি, তাও আর নেই? সে কথা পরের বার৷
এই লেখাটি আমার ব্লগেও পড়তে পারবেন http://indmusings.blogspot.com/
Read More...