২০০৮এর রেড স্কোয়ার রাশিয়া এখন
রাশিয়া এখন
২০০৮এর রেড স্কোয়ার
আগের লেখায় লিখেছি এবার প্রথম যেদিন রেড স্কোয়ার গেলাম- সে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা৷ ঠিক ঢোকার মুখে একি, খৃষ্স্টের মন্দির৷ পাশে ছিল লেনিন মিউজিয়ম, তার সব সাইনবোর্ড উধাও৷ তবে কি লেনিনের সমাধি, তাও আর নেই? সে কথা বলব, তবে রেড স্কোয়ার হয়েইতো লেনিন সমাধি যেতে হয়, তাই তার কথাই আগে বলি৷
মস্কো পৌছে থেকেই রেড স্কোয়ার যাবার ভীষণ ইচ্ছা৷ এবারে উঠেছি বন্ধুবর আশীষ দাসের বাড়ী, দমোদিয়েদভাতে, তা মস্কো শহরের বাইরে এবং রেড স্কোয়ার থেকো প্রায় মাইল পন্চাশেক দুরে ৷ আপনারা সবাই জানেন যে রেড স্কোয়ার মস্কো শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বিখ্যাত চক বা স্কোয়ার৷
বেশি বড় নয়, মাঝারি আকারের এক খেলার মাঠ৷ লম্বায় বেশি, চওড়ায় কম৷ শহরের অনেক রাস্তার শুরু এখান থেকে তাই রেড স্কোয়ারকে মস্কোর এবং রাশিয়ার কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচনা করা হয়৷ কালো পাথরে মোড়া, এক দিকে লেনিন মাভজলেই(সমাধি), তার পিছনে ক্রেমলিন, রুশ সরকারের কর্মস্থল, উল্টো দিকে, বড় সড় আকারের বিখ্যাত এক সুপার মার্কেট, নাম যার গুম৷গুমের পুরো হল রাশিয়ানে গসুদার্স্টভেন্নি উনিভার্সালনি মাগাজিন বা সরকারি সুপার মার্কেট৷ এটি সোভিয়েত আমলে সারা দেশের মধ্যে একটি বড় সুপার মার্কেট হিসাবে পরিচিত ছিল সেই আমাদের আমলেই অর্থাত ৭০, ৮০র দশকে৷ আজও মনে পরে, প্রথমে আমরা সবে মস্কোয় গেছি নিউবারাকপুর থেকে, যেয়েই সাতদিন ধরে গৃহবন্দী, কি না স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলবে, অর্থাত বাইরে যাওয়া বন্ধ৷ সব ধরনের পরীক্ষা টরীক্ষা হল৷ তার পর দিন আমাদের ক্লাস টীচার দল বেধে আমাদের নিয়ে চল্লেন বাসে করে, আমাদের জামা কাপড় কিনে দেওয়াতে রেড স্কোয়ারের পাশের, মস্কোর সব চেয়ে বড় সুপার মার্কেটে- গুমে৷ সেই প্রথম আমার গুম দেখা৷ লম্বা লম্বা ৩ সারি, প্রত্যেক সারিতে একের পর এক দোকান, উপরে একতলা, দোতলা, তিনতলা সর্বত্র দোকান, তাতে পাওয়া যেতনা এমন কিছু নেই৷ জামা কাপড়, বাসনপত্র, আসবাব, কি ছিলনা সেখানে ? আমাদের পছন্দ ছিল খুব সস্তায় ভাল আইসক্রিম পাওয়া যেত ২০ কোপেকে৷ সাদা পোষাক সাদা টুপি পরা আইসক্রিম বিক্রেতারা হিমসিম খেয়ে যেত ভিড় সামলাতে৷ দেখতে না দেখতেই আইসক্রিম শেষ৷ আবার ছুটে এক নিমেষে গলির মোড় থেকে ম্যাজিকের মত নিয়ে আসত আইসক্রিম৷
২০০৮ এর গুম বদলে গেছে অনেক৷ সেখানে এখন শুধুই ডিজাইনার এবং ব্রান্ডেড্ পোষাক পাওয়া যায়৷ আইসক্রিম আছে তবে মোড়কে মোড়া, নেই সেই স্বাদ, রং ও গন্ধ৷ আর দাম না জিগ্বেস করাই ভাল৷ ২০ কোপেকের আইসক্রিম এখন বিকোচ্ছে ২০ রুবলে৷ ভারতীয় মুদ্রায় যার দাম ৩২ টাকা৷ এবারে যাত্রায় সেপ্টেম্বর অক্টোবর দুমাসে বেশ কয়েকবার যখনই রেড স্কোয়ার গেছি , গুমে ঢুকে নিরাশ হতে হয়েছে বেশি কারণ সব জিনিস সাধারণ মানুষের ধরা এবং ছোয়ার বাইরে৷ রেড স্কোয়ারে দাড়িয়ে পুবমুখো তাকালে ডানদিকে পড়ছে লেনিন মাভজলেই(সমাধি), বা দিকে পড়ছে গুম৷ পেছন দিক দিয়ে পড়ে রেড স্কোয়ারে ঢোকার রাস্তা৷ সেই রাস্তার একদিকে ঐতিহাসিক মিউজিয়ম (Historical Musuem), অন্যদিকে লেনিন মিউজিয়ম ( Lenin Musuem)৷ মাঝখান দিয়ে কালো পাথরে মোড়া রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয়৷ সেইখানে হঠাতই এক ছোট আকারে এক গীর্জা বসানো হয়েছে, অর্থাত রেড স্কোয়ার ঢুকতে হলে আপনাকে প্রায় গীর্জার গায়ে গা লাগিয়ে যেতে হবে৷ আমারতো মনে হয় যে রেড স্কোয়ারের সৌন্দর্যের অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছে এই গীর্জার উপস্থিতিতে৷
সম্পাদক মশাই যদি আমার ঐ ছবিটি ছাপেন তাহলে দেখতে পাবেন সেই গীর্জাকে৷ তবে হ্যাঁ, এর পরে যত জায়গায় ঘুরেছি সর্বত্র চোখে পড়েছে নতুন নতুন চার্চ বানানো বা পুরানো চার্চে রঙ করাবার যেন ব্যাপক হিড়িক পরে গেছে৷ সোভিয়েত জমানার সমস্ত চিহ্ণ বদলাবার জন্য সরকারী তরফে প্রয়াস লক্ষনীয়৷
রেড স্কোয়ার ঢোকার মুখে খৃষ্স্টের মন্দির
এই গেটের বাদিকে (ছবিতে দেখা যাচ্ছেনা) লেনিন মিউজিয়ম৷ ছিল, কিন্তু আর নেই৷ বিশাল মিউজিয়ম ছিল, আমরা ছাত্র থাকাকালীন কতবার সেখানে গেছি, লেনিন সম্পর্কিত কত বই পত্র ইত্যাদি ছিল৷ আর আজ তাতে একটা সাইনবোর্ড অবধি নেই৷ চার পাশ দিয়ে ঘুরে অনেক খুঁজেও পেলাম না কোন চিহ্ন যা দিয়ে বোঝা যায় যে এই বিশাল বাড়ীটা এক কালে কত জমজমাট কত বিখ্যাত ছিল৷ মুল দরজার দিকে গিয়ে দেখি, মস্কোর টুরিস্ট বাসের টিকিট বিক্রী হচ্ছে সেখানে৷ আমাদের ভারতীয় বিবেচনায় দুই বাঙ্গালী জিগ্বেস করলেন ইংরেজীতে বলতে পারেন রেড স্কোয়ারটা ঠিক কোথায়৷ বুঝিয়ে দিয়ে বল্লাম কি করে যেতে হবে৷ তারা কলকাতা থেকে আসছেন, কথাবার্তার ধরণে বুঝতে অসুবিধা হয়নি৷ মজা লাগল এই ভেবে যে আজকাল কলকাতা থেকে অনেকেই রাশিয়া আসছেন বেড়াতে৷ আরোফ্লত সস্তার টিকিট দিচ্ছে ২০০০০ এ যাওয়া আসা৷ খারাপ নয়৷ যে কথা বলছিলাম, লেনিনের নাম মুছে দেবার প্রয়াস অব্যাহত৷ আমাদের সময়ে মস্কো মেট্রো(ভুগর্ভস্থ রেলপথ) করে রেড স্কোয়ারে আসতে হলে যে স্টেশনে নামতে হত তার নাম ছিল মার্কস প্রসপেক্ট(Prospect Marxa), তার আগের স্টেশনের নাম ছিল লেনিন লাইব্রেরী, তারও কয়েক স্টেশন আগে লেনিন স্টেডিয়ামের স্টেশনের নাম ছিল লেনিন পাহাড়৷ আজ এসব বদলে গেছে৷ মেট্রোয় চড়ে স্টেশনের লিস্ট দেখে বুঝে উঠতে পারিনা রেড স্কোয়ারে যেতে হলে কোন স্টেশনে নামতে হবে৷ এক সহযাত্রীকে জিগ্বেস করে জানলাম যে মার্কস প্রসপেক্ট(Prospect Marxa) স্টেশনে নামবার কথা কিন্তু এই স্টেশনটি বন্ধ আছে তাই অন্য একটি কাছের স্টেশন যার নাম থিয়েটার চক, তাতেই নামতে হবে৷ থিয়েটার চক থেকে বেরিয়ে আমার এত পরিচিত জায়গা, কিন্তু কিছুই আর চিনতে পারিনা৷ কারণ, ফুটপাত জড়ে গোলাকার, চৌকো নানান রঙের ছাতার নিচে সারি সারি দোকান তাদের পসরা সাজিয়ে বিক্রীবাটা করছে৷ এ দৃশ্য আগে ভাবা যেতনা৷ এখন সবাই ব্যাবসাদার৷ এর আগে বলেছি ব্যাঙের ছাতার মত সারা শহর জুড়ে চার্চের মেলা তার সঙ্গে আরো জুড়ে দেওয়া যায় দোকানদারী৷ দোকান আর দোকান শুধু দোকান৷ পূজীতন্ত্রের লাভ উঠাতে সবাই ময়দানে নেমে পড়েছে৷ এই সমস্ত দোকানদের পাশ কাটিয়ে আমরা চলেছি, হঠাত নজরে পড়লো লেনিন মিউজিয়মের মুল দরজার পাশে স্লোগান মুখরিত একদল বৃদ্ধ বৃদ্ধা লাল পতাকা হাতে, সবাই মিলে স্লোগান দিচ্ছে, ইন্টারনেশানাল গান গাইছে৷ কেউ কেউ আবার কিছু পত্রিকা বিক্রী করছে৷ কেউ চাঁদা সংগ্রহ করছে কৌটো ঝাকিয়ে৷ এরা কারা, রাশিয়ান কমুনিস্ট পার্টির কেউ , কাছে দিয়ে দেখি এরা বলশেভিক, পুরানো কমুনিস্ট, এরা সবাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরে চায়৷ পাশ দিয়ে জনগন চলেছে, কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ মাঝে মাঝে পুলিস এদের হটাচ্ছে৷ এ দৃশ্য কোন দিন ভাবা যেতনা সোভিয়েত ইউনিয়নে৷ কয়েকটা পত্রিকা কিনলাম জানতে এরা কারা৷ এরা কমুনিস্ট পার্টির নানান উপদলের সদস্য৷ সবাই অবসর প্রাপ্ত৷রাশিয়ার নতুন পুঁজীবাদের স্টিমরোলারের নিচে এরা সবাই পিষ্ট৷ এক হেরে যাওয়া লড়াইয়ের সৈনিক৷
এদের পাশ কাটিয়ে একটু দুরে চলে এসেছি৷ রেড স্কোয়ারে ঢোকার আরও একটি গেট৷ এর পাশেই অজানা সৈনিকদের স্মৃতিসৌধ৷ ঠিক ক্রেমলীনের দেওয়ালের পিছনেই৷ সোভিয়েত আমলে দেশি বিদেশি নেতারা মস্কোয় এলে লেনিন সমাধির পরে দ্বিতীয় যে স্থানে অতি অবশ্যই যেতেন তা হল এই অজানা সৈনিকদের স্মৃতিসৌধ৷ ক্রেমলিনের দেওয়ালের ঠিক পিছনে লাগোয়া৷ ২৪ ঘন্টা সেখানে জ্বলে আগুন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সমস্ত সোভিয়েত সৈন্যেরা প্রাণ দিয়েছেন দেশের রক্ষায় তাদের স্মৃতিতে এই সৌধ৷
রেড স্কোয়ারে ঢুকতে নিয়েছি, ২ জন পুলিস বাধা দিয়ে বল্ল ঢোকা যাবেনা রেড স্কোয়ার বন্ধ, সে কি কেন, জিগ্বেস করায় বল্ল কিছু ইউরোপীয় দেশের মিলিটারী ব্যান্ডের অনুষ্ঠান চলবে এক সপ্তাহ কাল তাই রেড স্কোয়ার বন্ধ থাকবে ৷ এমনতো কোন কালে হয়নি যে রেড স্কোয়ার বন্ধ থাকবে এতদিন ধরে৷ কিন্তু আমরা খালি লেনিন সমাধি দেখতে চাই তাও যাওয়া যাবোনা৷ কি আর করা যাবে, এযাত্রায় হবেনা৷ আবার আসব৷ আসতে হবে বিশেষ করে, কারণ সোভিয়েত দেশ পতনের পরে প্রথম ১৫ বহু বছর অনেক চেষ্টা হয়েছে লেনিনের দেহ এখান থেকে তুলে দেবার৷ বিশেষ করে ইয়েল্টসিন অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্ত সফল হয়নি সে প্রয়াস৷ কি সেই চেষ্টা আর সমুহ রাষ্ট্রশক্তি সব জোর লাগালেও কেন তা সফল হয়নি৷ কেন লেনিনের সমাধি আজও রেড স্কোয়ারে বিরাজমান সে কথা বিস্তারিত বলব পরের বার৷ লেনিনের সমাধির ইতিহাস, কি করে তা তৈরী হয়েছিল আর কি ভাবে হাজার লক্ষ মানুস, কমুনিস্ট, অ-কমুনিস্ট, এক নিরব নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন আজও লেনিনের সমাধিকে রেড স্কোয়ারে রাখতে তার কাহিনী৷ চোখ রাখুন নগরের কথার পাতায়৷
এই লেখাটি আমার ব্লগেও পড়তে পারবেন http://indmusings.blogspot.com/ আপনার মতামতও সেখানে জানাতে পারেন৷